ভাস্কর চৌধুরী | কয়েকটি কবিতা
ভাস্কর চৌধুরী | কয়েকটি কবিতা
পাহাড়ের ঘুম

তোমার ছিলো না, আমার তো ছিলো আরো একরাত
আমার তো ছিলো আরো একরাত বাঁচিবার সাধ
আমি কতভাবে কতঘরে কতভাবে বাঁচি,
ঘুমের আশ্রয় চিরকাল একটি শরীর।
অতিকায় মেঘ চিরকাল আকাশচারী হয়, আকাশে ঘুমায়
তার আকাশ আছে কিনা ভাবনায় আসে, আকাশবিহারি পক্ষীকুল জানে, আর কত উপরে আকাশ রয়েছে,
নাকি আমরা পাহাড়ে উঠলে যা দেখি, আকাশ দিব্বি মেলে দিয়ে পাখা, মাথার অনেক উপরে
আর পায়ের তলায় মেঘ, গায়ের ভেতর মেঘগুলি
বৃষ্টিপাত করে
বৃষ্টির জল গিরিখাদে যায়, আকাশ চমকায়, আবার শান্ত হয়
শান্ত থাকা চিরকাল পাহাড় স্বভাব, মানুষগুলোর মুখ দেখি
সকল পাহাড়ের মানুষের মুখ, একই রকম কিনা ভাবি
এবং মনে পড়ে, দার্জিলিং অথবা বান্দরবানের মানুষগুলির মুখ
মনে পড়ে যায় জাফলং এর পানের পঞ্জির মানুষের মুখ
পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীর মুখগুলি, একই রকম খরস্রোতা হয়
পাহাড়ের মানুষের মুখ, তাদের চামড়াগুলি এতটা নরম
মনে হয় বার বার নারীদের গাল গুলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি
পাহাড়ের চূড়ায় ক্যানো শীত বেশি, শীত শীত ভাব থাকে ক্যানো,
পাহাড়ে এতো এতো বৃষ্টিপাত ক্যানো হয়,
পাহাড়ের পেটে এতগুলো পাথর , বড় ও বিশাল পাথর কোথা থেকে আসে?
ধাপে ধাপে উঠি আর ধাপে ধাপে নামি, কোথাও থামার নিয়ম নেই
মনে হয় থেমে থেমে ঢালগুলো দেখি , ঢালের পাশের পথ
যেনো আকাশের সিঁড়ি, নেমে যেতে হলে থামার নিয়ম নেই
কেও যদি ভুল করে থামে, পেছন থেকে কেউ এসে জোর করে ফেলে দেয়
পাহাড়ের ঢালে মানুষ কিভাবে বসত বাঁধে, ঢাল থেকে পাশে গিয়ে নেমে যেতে হয়
নেমে গেলে আকাশটাও নেমে আসে, সেখানেও বৃষ্টিপাত ঠিকমতো হয়
পথের মাঝে দাঁড়ানোর নিয়ম কখনই নেই, পথপাশে সামান্য ভূমি পেলে তবে
পাশ থেকে পাহাড়ের চুড়ো পুনরায় দৃশ্যমান হয়
ওখানে চায়ের বাগানগুলো ঢাল বেয়ে নামে, ঢাল ছাড়া মানুষের জীবনযাপন
অতি সাধারণ জীবনযাপন গুলি সেখানেই থাকে।
এতোটা সরল, তরল মেয়েরা সারি বেঁধে নামে
আঁক বাঁক দেখে দেখে সারাটা জনম, পাহাড়ি মানুষ বুঝি চোখ বুঁজে হাঁটে।
জীবন সূত্র

মাছের আঁশের মতো কি নিপুন থরে থরে সাজানো মানুষের রগ রেশা
সুচিক্কন রক্তনালীর ভেতরে পল পল রক্তের নিত্য প্রবাহ ঢেকে নিয়ে থাকে
পরতে পরতে মাংস ও চামড়ার আস্তরণ
লোমকূপ তার বর্জ্য নিষ্কাশনে সদা ক্রিয়াশীল
আট কুঠরিতে নয়টি দরজা কপাট ক্রিয়াকর্ম করে
মানুষের এনাটমি সে এক অপার বিস্ময়, মাছের আঁশগুলি তার চে কম নয়, মাছের এনাটমি আরো বিস্ময়
এইভাবে জীব ও জীবনের সকল পর্যায়ে মানুষ মাছ ও পক্ষীকুলের ভেতরে
আকাশ জল ও ভূমি বাসের জন্যে বাটোয়ারা হয়, কিভাবে এমন হয়, কথাটা ভাবলেই পরবর্তী ধাপে
সকল জীবের জীবন ও দেহতত্ত্বের নিবাস অথবা এনাটমি আসে।
আগুন থেকে ধুঁয়োর উদ্গীরণ, নিয়ন্ত্রণে কয়েক ছিটা জল
চালার উপর লতানো লাউ গাছ, দুয়ারে এসে বসে গ্রামের বাউল
ঘরপোষা গৃহপাখি মায়ের দৃষ্টি কোনোদিন এড়াতে পারে নি
কয়েক মুঠো ভাত চাল চালায় উঠোনে দিলে পাখি খেয়ে উড়ে যায়
এ জীবনে, জগৎ সংসারে কিছু বাঁধা আছে টানটান হয়ে
ধনুকের ছিলার মতো মানুষের নিত্য ক্রিয়া এই সব সম্পাদন করে।
ওদিকে নদীর জল, বৃক্ষবন, কিছু অনটন, কিছুটা বাড়তি প্রয়োজন
কিছুটা বাড়তি বোধে, নাক্ষত্রিক আলো থেকে
আমাদের রক্তের ভেতরে গ্লুকোজ সুক্রোজ কতো কিছু আসে
ঠিক এইভাবে সাজানো জগতে, দিন ও রাতের প্রয়োজনগুলি
নারী ও পুরুষের যৌথ সম্ভোগ, সম্ভাসনে, আবেগে সুগভীর আচরণে পূর্ণতা পেয়ে যায়
কিছু মানুষ সৃষ্টিশীল , শিল্প ও সাধনায় লিপ্ত হয়ে
জীবনের গুপ্ত সত্য নিত্য সাজিয়ে তোলে
শব্দ থেকে স্বর নিয়ে, জল থেকে মাটি থেকে ফুল থেকে
শত মিশেলে গড়ে তোলে রঙের আস্তরণ
খাতায় খাতায় জেগে উঠে, স্বরের বিচ্ছরণ
আকাশ ও পাহাড় থেকে টন টন আলো, কি ভালো
যেখানে যতটুকু লাগে সংগোপনে বিলি হয়ে যায়
সংগোপনে সকল কিছু গতিশীল থেকে আমাদের মাঝে ক্রিয়া করে যায়
জলের প্রপাত গুলি, গতির জগতে কাজ করে যায়
নদীর স্রোত গুলি সহ্য বর্জ্য টেনে নিয়ে যায়
আমরা চিন্তার জগতে যদি ধাপে ধাপে এইসব সাজাতে পারি
ধারাবাহিক পেয়ে যেতে পারি সংগীতের মতো বাজে
এইসব গুপ্ত ক্রিয়াগুলি
এ শুধু আমাদের সব নিজে, সুনিপুন মাছের আঁশের মতো সাজিয়ে রাখা
মানুষের রক্ত রেশার উপরে যেমন চামড়ার আস্তরণ
চিন্তার জগতে শিল্পীর হাত নিত্যক্ষণ
এঁকে রেখে যায় আমাদের ইতিকথা, জীবনযাপন ।
বিস্ময়ে মরি

আমার সময় নেই, সুরমিতা তুমি বলেছিলে
আমি বিস্ময়ে ভাবি, সময় কিভাবে থাকে না তোমার?
আমি এক লক্ষ বছর কেবল এই বারান্দায়
শীতের কোট গায়ে অপেক্ষা করেছি
সেই পথ, আমাদের গ্রামের পথে অনেক ধুলো
তাতে কারো তো আসতে পা আটকে না
তোমার সময় হলো না আসার, আমি বিস্ময়ে মরি।
তেলুক মাছের মতো স্বচ্ছ গভীরে
ঘুমের মতো স্বাভাবিক সাঁতার কাটতে জানো
আমি জানি মেঘের ভেতর পাখির মতো তুমি
মেঘের জামা গায়ে নেমে আসতে জানো
আমার অসুখ জেনেও সময় হলো না তোমার
আমি বিস্ময়ে মরি।
চিন্তাসূত্র
.
মৃত্যুর আগে আমি মৃত্যুকে কয়লা করেছি,
কাঠ পুড়িয়ে কয়লা করেছি,
কাঠের জীবন ছিলো, আমি চিতায় তুলে কাঠ দেহকে ভস্ম করেছি।
জীবনের আয়ু পুড়ে গেছে, বায়ু পুড়ে গেছে, মৃত্যু পুড়ে গেছে
আমি মৃত্যুকে চিতায় তুলে ভস্ম করেছি।
নদীর একুলে ওকুলে, দুই কুলে দাঁড়িয়ে দেখেছি দুই হওয়া
জীবনটা চিমনির ভাটায় পুড়ে ধোঁয়া হয়ে উড়ে গেছে
ভাবনায় আসে, যখন শ্মশানে দাঁড়িয়ে তোমাকে পোড়াতে দেখে
ধোঁয়াতে আমি চোখ মুছে তোমাকেই স্মরণ করেছি
তুমি মরোনি, তোমার দেহ মরে গেছে, তুমি আমার ভেতরে আছো।
আজও গায়ত্রী রাতে আমি ছাদে যাই, মাদুর পেতে শুয়ে শুয়ে একা ভাবি, তারকার মৃত্যু শুধু তারকা হয়েই থাকে, আকাশ ভরা মৃত তারকার মেলা বসে, বড় নক্ষত্র কেউ কেউ তাদের গ্রাস করে
আমিও তোমাকে গ্রাসের ভেতর রাখি, অথবা আমার চিন্তায় তুমি গ্রাসভুক্ত থাকো
চিন্তা কোনো মৃত্যু নাকি মৃত্যুই চিন্তা এক , এও ভাবি
চিন্তার শব্দরূপ ক্যামন হতে পারে? শব্দে চিন্তা ফোটে কিনা ভাবি।
অক্ষয় কিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা চিন্তা করি।
এইসব চিন্তা , চিন্তকের ভেতরে কিছু এলাকা বাড়িয়ে দেয়
চিন্তার এলাকাগুলো , আরেক চিন্তা তৈরি করে থাকে
আমাদের এলাকার মজিদ একদিন ফিরে এসে জলে ফু দিয়ে বলে,
আমার শ্বাস থেকে, কিছু শ্বাস তোমার আয়ুকে দিলাম
এ কথা যুক্তিতে আমি এনে চিন্তা করি, ব্যাখ্যা করি
জীবনের ফু গুলি আসলে একেকটি বিশ্বাস।
আমি এইরূপ অনেকবার, তোমার মুখে মৃত্যুর মুহূর্তে ফু দিয়ে তোমাকে বাঁচাতে অক্ষম হয়েছি।
অক্ষমতা মানে কোনো বিশ্বাস নয়,অক্ষমতা একটি শূন্য সৃস্টি করে।
সেই শূন্যের ভেতর থেকে আরেকটি নতুন চিন্তা জন্ম লাভ করে।
ভাবি, সকল চিন্তা , শূন্যতা থেকে সৃষ্ট হয়, মাথা ভর্তি চেতনায় যোগ দেয়।
আমি চিন্তাকে তাই শূন্যের পুত্র অথবা কন্যা মনে করি।

সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান